কানের ভিতর থাকা পুতির সন্ধান পওয়া গেল ২২ বছর পর।
যেভাব কানে পূঁতি ঢুকেছিল।
১৯৮৬ সালে ১১বছর বয়সে বান্ধবীর সঙ্গে খেলাচ্ছলে দুষ্টুমি করে তারই গলার ছিঁড়ে যাওয়া লাল রঙের পুঁতির মালার একটি পুঁতি ডান কানের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কানে পুঁতি ঢোকার বিষয়টি তখন সবাইকে বলেছেন রাশেদা। কারণ কানে পুঁতি ঢোকার জন্য কানে ব্যথা হচ্ছিল, কান বন্ধ হয়ে ছিল। প্রথমে স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক পুঁতিটি বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় তখন তাকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তার কান থেকে পুঁতি বের করার কথা বলা হলেও বের করা পুঁতিটি দেখানো হয়নি।
বলা হয়েছিল বের করার সময় পুঁতিটি ভেঙ্গে গিয়েছে তাই দেখানো সম্ভব হয়নি। ফলে মনের সন্দেহ পুরোপুরি দূর হয়নি রাশেদার। তারপর থেকে কান ভাল না হয়ে কিছুদিন পর থেকে তার ডান কান পেকে গিয়ে পুঁজ পড়তে থাকে এবং ফলে হ্রাস পেতে থাকে শ্রবণশক্তিও। ইতোমধ্যে বিয়ের পর দুই মেয়ে ও এক ছেলের মা হয়েছেন রাশেদা। কানের সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ ২২ বছরে বহু নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। খুঁজে না পাওয়া সেই লাল পুঁতিটি যে কানেই থাকতে পারে এমন সন্দেহের কথা রাশেদা কাউকেই কখনো বলেন নি। এ কারণে কান দিয়ে পুঁজপড়া, শ্রবণশক্তি হ্রাসের চিকিৎসা হলেও কানের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া লাল রংয়ের সেই পুঁতিটি খোঁজেন নি কোন চিকিৎসকই। অবশেষে ২০০৮ সালে অধ্যাপক জিল্লুর রহমানের শরণাপন্ন হলে তিনি রাশেদাকে অপারেশনের পরামর্শ দেন কানপাকা রোগের জন্য। অপারেশনের পর পুঁতি বের হওয়ার কথা শুনে রাশেদা মোটেই অবাক হন নি। সহজেই ২২ বছর পরও চিহ্নিত করতে পেরেছেন কানের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া পুঁতিটিকে। পুঁতিটি বর্হিবর্ণ থেকে মধ্যকর্ণে যেয়ে ক্রমাগত ইনফেকশনের সৃষ্টি করেছে। আর সেই ইনফেকশন ওষুধে না সারার কারণে অপারেশন করতে যেয়ে ফিরে পাওয়া গেল হারিয়ে যাওয়া লাল পুঁতিটিকে।চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ এলাকার রাশেদা বেগমেরও কানপাকা রোগ। ছোটবেলা থেকেই ডানকানে তার এই সমস্যা। প্রায়ই কান দিয়ে কষ ঝরে, পুঁজের মত পড়ে। প্রথম দিকে স্থানীয় চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা করা হল। দেয়া হল রাজ্যের ওষুধ। কিন্ত তেমন কোন লাভ হল না। রোগ একটু কমে কিন্তু আবার কান দিয়ে পুঁজ পড়ে। এবার চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম যাত্রা। সেখানে বড় নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ দেখান হল। চিকিৎসা দেয়া হল। চিকিৎসার জন্য এত তোড়জোড়ের কারণ হল, কিছুদিনের মধ্যেই রাশেদার বিয়ে হবে। বিয়ের আগে কানপাকা রোগ সারাতে হবে। এবার এন্টিবায়োটিকসহ নানা ধরণের ড্রপ ও মলম দেয়া হল কানে। এ যাত্রা কান কিছুটা শুকালোও বটে।
যা হোক বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও কানের অস্ব¯স্তি কাটেনি রাশেদার। কিন্তু শ্বশুড় বাড়িতে নিজের কানের রোগের বিষয়টি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। কান খারাপ হলে লুকিয়ে লুকিয়ে পুরোনো প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করে ওষুধ খেতেন, কানে দিতেন। এভাবেই কেটে যায় আরো ৩/৪ বছর। ইতোমধ্যে রাশেদা ৩ সন্তানের মা হয়েছেন। দৈনন্দিন জীবনের সব কাজকর্মই করছেন কিন্তু নিরবে সহ্য করে চলেছেন ডান কানের যন্ত্রণা। যতই দিন যাচ্ছে কান নিয়ে তিনি যেন আর পারছেন না। আজকাল কানের ব্যথা বেজায় বেড়েছে। কানটা ভারি হয়ে থাকে। কান দিয়ে পুঁজ পড়ে। সেই সাথে কান কম শোনাও যোগ হয়েছে।
অবস্থা যখন অনেক খারাপ হয়ে যায় তখন আর বিষয়টি চাপা থাকে না। প্রথমেই স্বামীর নজরে আসে বিষয়টি। তবে স্বামীকে রোগের দীর্ঘ ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বলেন নি। স্বামী তাকে নিয়ে আবারও চট্টগ্রাম আসেন ভাল চিকিৎসার আশায়। এদিকে চট্টগ্রামে প্রতি শুক্রবার ঢাকা থেকে রোগী দেখতে আসেন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জিল্লুর রহমান। রাশেদাকে নিয়ে অধ্যাপক জিল্লুরের কাছে আসেন তার স্বামী। রাশেদাকে পর্যবেÿণ করে রোগ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন অধ্যাপক জিল্লুর। সব প্রশ্নেরই কোন না কোন উত্তর দিলেও রোগটি কতদিনের? গ্রাম্য মেয়েলী লাজুকতায় এই প্রশ্নের উত্তর সহজেই এড়িয়ে যেতে সামর্থ হন রাশেদা। পরীÿক্ষা নিরীÿক্ষার পর সিদ্ধান্ত হয় রাশেদার ডান কানে অপারেশন লাগবে। ওষুধে সারবে না। কানের মধ্যকার গাঠনিক কোন কিছুই স্পষ্ট করে চেনা যাচ্ছিল না বলে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত দিলেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান। আর অপারেশন করতে আসতে হবে ঢাকায়। কারণ অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় যান্ত্রিক ও লোকবল কোনটাই চট্টগ্রামে তখন ছিল না।
অবশেষে ২০০৮ সালের অক্টোবরে মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় অপারেশনের জন্য আসেন রাশেদা। অধ্যাপক জিল্লুর রহমান কান পাকা রোগের চিকিৎসা হিসাবে মডিফাইড বা রেডিক্যাল ম্যাসটয়েডকেটমী ধরণের কানের অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী অপারেশন করতে যেয়ে প্রথমে বর্হিকর্ণ দিয়ে মধ্যকর্ণে ঢুকে লাল রঙের দানাকৃতির কিছু একটা মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখতে পান তিনি। জিনিসটি বেশ শক্ত বলেও মনে হয়। কিন্তু আশেপাশের ঝিলিøর সাথে এতটাই শক্তভাবে গেঁথে আছে যে কোনভাবেই সেটিকে আলাদা করা যাচ্ছিল না। এভাবে বের করতে গিয়ে সফল না হয়ে কানের পেছন দিকে দিয়ে মধ্যকর্ণে ঢুকে সেখান থেকে অপারেশন করে লাল ব¯Íটি বের করে আনেন। পরিষ্কার করার পর দেখা গেল লাল ব¯Íটি একটা পুঁতি। সাধারণত মালা তৈরীতে এ ধরণের পুঁতি ব্যবহৃত হয়। পুঁতিটি বের করার পর কান পাকা রোগের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যান অধ্যাপক জিল্লুর। পুঁতিটি মধ্যকর্ণে থাকার জন্য আশেপাশে বারবার প্রদাহ হয়েছে। ইনফেকশন হয়েছে, হয়েছে আরো কিছু পরিবর্তন। যার ফলে কানের এই অবস্থা। যা কখনোই ওষুধে সারত না। পুঁতি বের করার পর কানের ভেতরের সমস্ত ময়লা বের করে সেখানকার ছোট ছোট হাড় পূনর্নির্মানসহ (ওসিকুলোপ্লাস্টি) কানের পর্দা জোড়া লাগিয়ে (ম্যারিংগোপ্লাস্টি) দেয়া হল। এ অপারেশন সম্পূর্ণ অজ্ঞান না করে শুধুমাত্র ডান কান অবশ করেই করা হয়েছে। কাজেই অপারেশনের সময় ডাক্তারদের সব কথাই শুনছিলেন রাশেদা। পুতিঁর কথা শুনতে শুনতে তারও মনে পড়ে যায় ছোট বেলায় কানের মধ্যে ঢুকে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া সেই পুঁতির কথা।
কানের মধ্যে পুঁতি: পেছন ফিরে দেখা
কানের মধ্যে পুঁতি: পেছন ফিরে দেখা
No comments:
Post a Comment